শুক্রবার, ০২ জুন ২০২৩, ০৭:৫৮ পূর্বাহ্ন

নোয়াখালীর গর‌িবের ডাক্তার বোরহান উদ্দিন

পরিচিত অপরিচিত কাউকে ফোন দিলেই বলেন, আমি বোরহান উদ্দিন! অপরিচিতরা পদ পদবিবিহীন এই পরিচয়ে চিনতে প্রায়ই ভুল করলেও পরে বুঝতে পারেন তিনি সকলের আস্থার মানুষ ডা. বোরহান উদ্দিন। যশখ্যাতির জন্য মানুষ যখন নিজেই নিজের নামের সাথে ন্যায্য অন্যায্য অনেক কিছুই যোগ করেন তখন নিভৃতচারী এ মানবসেবক কখনোই নিজের নামের সাথে ডাক্তার শব্দও ব্যবহার করেননি।

নোয়াখালী জেলা সদরে চরাঞ্চল থেকে আসা স্বাস্থ্যবিষয়ক সাহায্যপ্রার্থীসহ হেন উপকার নেই যা তিনি করেন না। এলাকার রোগী, চেনা-অচেনা সাহায্যপ্রার্থী শহরে আসলেই নিঃস্বার্থভাবে সব কাজ রেখে তাদের পাশে দাঁড়ান এ মহান মানুষটি।

বলছি, কিংবদন্তির জীবন্ত মহানায়ক ডাক্তার বোরহান উদ্দিনের কথা। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরবাটা গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৫৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতাও পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। স্থানীয় খাসেরহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সাফল্যের সাথে বিজ্ঞান শাখা থেকে এসএসসি পাস করে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়েন ঢাকা কলেজে। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্বিবদ্যালয়ে ইংরেজি নিয়ে অধ্যয়ন করেন। সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি নিঃসীম টান থেকে তিনি পরে ঢাকা কলেজে আবার বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী বোরহান উদ্দিন ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি মেডিকেল বোর্ড থেকে বোর্ড স্ট্যান্ডসহ ডিএইচএমএস পাশ করেন। ছাত্রবেলা থেকেই প্রতিভাবান এ লোকটির লেখার হাত ছিল শক্তপোক্ত। বলা হয়ে থাকে নোয়াখালী থেকে এখনও এমন কোনো মানসম্পন্ন ম্যাগাজিন বের হয়নি যাতে তার লেখা ছিল না।

পাঠ চুকিয়ে তিনি দেশের প্রাচীনতম পত্রিকা ‘দৈনিক সংগ্রামে’র সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করে অদ্যাবধি জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। পেশাগত সততা ও নিষ্ঠার কারণে দলমত নির্বিশেষে জেলার সাংবাদিকদের মাঝেও অগ্রগণ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন। সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, প্রেস ক্লাবের সাহিত্য সংস্কৃতি, ধর্ম সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন লাগাতার।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি ২০০০ সাল থেকে বাংলা বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় ২০১০ সালে অধ্যাপনা ছেড়ে দিলেও সবার অনুরোধে তিনি ধ্বংসপ্রায় নোয়াখালী হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি নোয়াখালীর সর্ব বৃহৎ হোমিও চিকিৎসা কেন্দ্র ইউনিক হোমিও হলে প্রায় দশজন সহকারী চিকিৎসকসহ নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

সব্যসাচী মানুষটি শিক্ষা বিস্তারেও ঈর্ষণীয় অবদান রাখেন। নোয়াখালী জেলার স্বনামধন্য আল ফারুক একাডেমি, দারুল ফালাহ এতিমখানা ও চরবাটা মহিলা মডেল দাখিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

বাইপাস সার্জারির আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তিনি সক্রিয় থেকে মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে যান। ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-৪ আসন থেকে অংশগ্রহণ করেন।

ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের বিষয়ে বরাবরই ছিলেন আন্তরিক। বর্তমান নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দুর্বৃত্ত কর্তৃক ছুরিকাহত হলে বোরহান উদ্দিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। সে সময় জেলার সবচেয়ে আলোচিত ও সুপরিচিত ব্যক্তিতে পরিণত হন তিনি।

সকল কিছু ছাপিয়ে ডাক্তার বোরহান উদ্দিন একজন প্রচারবিমুখ মানবহিতৈষী। দুস্থ মানুষের সেবার জন্য মানবকল্যাণ মজলিশ নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন গড়ে শতাধিক রোগীর বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ সেবা দিচ্ছেন ইউনিক হোমিও হলে বসে। এক সময় বৃহস্পতিবার এ কার্যক্রম চালু থাকলেও সেবাপ্রার্থী বাড়ায় শনিবারও এ কার্যক্রম চলতে থাকে। বর্তমানে সাপ্তাহে সাত দিনই তিনি দুস্থদের জন্য বিনামূল্যে এ সেবা অব্যাহত রেখেছেন। নিজে হার্টের রোগী হওয়া সত্ত্বেও ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও করোনাসহ সকল রোগের চিকিৎসা দিচ্ছেন মহামারির এ সময়েও। বেসরকারি চিকিৎসা খাত যখন নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে তখনও তিনি দৃঢ়তার সাথে সশরীরে সকল রোগীই দেখছেন। চেম্বার বন্ধের পরও তিনি নিরলসভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে রোগীদের সেবা দেন।

নিজের জন্মস্থানের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পৌঁছাতে তিনি সুবর্ণচরের আন নুর ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় প্রতি বুধবার চরবাটা খাসেরহাটে ফ্রি সেবা দিচ্ছেন।

জেলা সদর মাইজদীতে সর্ব মহলে গ্রহণযোগ্য এ ব্যক্তি বহু মানুষকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন। বেওয়ারিশ লাশ দাফন, কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার উপযুক্ত কন্যাদের যৌতুকবিহীন বিবাহ, ঈদ ও শীতবস্ত্র প্রদানসহ নিয়মিত ত্রাণ কার্যক্রমে ব্যাপৃত আছেন বোরহান উদ্দিন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলিত সম্প্রদায় থেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত এক ব্যক্তি জানান, ‘বোরহান স্যারের মতো এ রকম মানুষ এ জীবনে আর দেখবো কি না জানি না। একদিন তিনি আমায় ডেকে নিয়ে চাউল আটা কিনে দিয়ে পেছন থেকে ডাক দিয়ে বললেন এগুলো খাবে কী দিয়ে? ধরো এ টাকা দিয়ে একটা মোরগ কিনে নিও। শুধু তা-ই নয়, যাওয়ার সময় বোরহান সাহেব আমাকে রিক্সা ভাড়াটাও দিয়ে দিলেন।’ কথাগুলো বলার সময় ওই নওমুসলিম ব্যক্তির চোখ দুটো দিয়ে দরদর করে পানি গড়িয়ে পড়ছিল।

বিরলপ্রজ এ মানবতাবাদী এখনও প্রতিদিন রুটিন করে বই পড়েন, সপ্তাহে দুদিন নিজের চেম্বারে শিক্ষানবিশ ডাক্তারদের হাতেকলমে ফ্রি হোমিওপ্যাথি শেখান। তাঁর শেষ ইচ্ছা তিনি যেন অসহায় রোগীদের জন্য স্থায়ী ভবনে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে যেতে পারেন। তিনি চান তাঁর অবর্তমানেও এ সেবা কার্যক্রম চলমান থাকুক।

আজ মহান এ চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক, সমাজসেবকের শুভ জন্মদিন। এ দিনে আমরা তাঁকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাচ্ছি।

লেখক:প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, সোনাইমুড়ি সরকারি কলেজ

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published.

পুরাতন খবর

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০  
© All rights reserved © 2017 nktelevision
Design & Developed BY Shera Web