সোমবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ১২:৪৬ অপরাহ্ন
নাছির উদ্দিন, প্রতিবেদক, কোম্পানীগঞ্জ: সম্প্রতি নির্বাচন, রাজনীতি, সন্ত্রাস, মাদক, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আওয়ামী লীগের এমপি ও নেতাদের নিয়ে একাধিক বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় এসেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সহোদর নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা।
এরই মধ্যে জনসমক্ষে দেয়া তার এ ‘সত্য বচনের’ ভিডিও ফেসবুক ও ইউটিউবে ভাইরাল হয়েছে। অনেকে হয়েছেন বিরাগভাজন, কেউবা হয়েছেন খুশি। তবে এ সত্য বলার পরিণতি হিসেবে তাকে দেয়া হচ্ছে অব্যাহত হুমকি। তিনি এ হুমকিকে তোয়াক্কা না করেই নির্বাচনী গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। জনগণকে সাক্ষী রেখে বলেছেন, ‘যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন সাহস নিয়ে সত্য কথা বলে যাব। এতে মৃত্যু হলেও তাতে পরোয়ানা করি না।
মূলত ৩১ ডিসেম্বর বসুরহাট পৌরভবন চত্বরে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণাকালে আবদুল কাদের মির্জা বলেন, ‘বৃহত্তর নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের কিছু কিছু চামচা নেতা আছেন, যারা বলেন অমুক নেতা, তমুক নেতার নেতৃত্বে বিএনপির দুর্গ ভেঙেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিন-চারটি আসন ছাড়া বাকি আসনে আমাদের এমপিরা পালানোর জন্য দরজা খুঁজে পাবে না। এটিই হলো সত্য কথা। সত্য কথা বলতে হবে। আমি সাহস করে সত্য কথা বলছি।’
এ সময় কাদের মির্জা নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় দলীয় কিছু নেতাকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘নোয়াখালীর মানুষজন বলে, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এটি সত্য। কিন্তু আপনাদের (নোয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতা) জনপ্রিয়তা বাড়েনি। আপনারা প্রতিদিন ভোট কমান। টাকা দিয়ে বড় জনসভা করা, মিছিল করা কোনো ব্যাপার নয়। টাকা দিলে, গাড়ি দিলে আমিও অনেক লোক জড়ো করতে পারব। না হয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেব।’
‘নোয়াখালীর রাজনীতি অতি কষ্টের। জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সহসভাপতি পদে ওয়ান ইলেভেনের সেনাপ্রধান মইন উ আহম্মেদের ছোট ভাই মিনহাজ আহম্মেদ জাবেদ ও হাওয়া ভবনের লোক আতাউর রহমান মানিক ভূঁইয়ার নাম রয়েছে। তাদের মতো লোক কীভাবে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে স্থান পায়’, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
কাদের মির্জা বলেন, বৃহত্তর নোয়াখালীতে আমাদের নেতা ওবায়দুল কাদের, মওদুদ সাহেব (বিএনপির মওদুদ আহমদ), আবু নাছের সাহেব (জামায়াতের) এই তিনজন ছাড়া তাদের সমমর্যাদার কেউ নেই। কোনো নেতা সৃষ্টি হয়নি। এখন তো ওবায়দুল কাদের, মওদুদ আহমদের নাম বিক্রি করি। তারা তিনজন তো অসুস্থ, তারা মারা গেলে কার নাম বিক্রি করবেন, কেউ নেই।’
কারো নাম উল্লেখ না করে আবদুল কাদের মির্জা বলেন, ‘প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেন, তারা হচ্ছেন নেতা। টেন্ডারবাজি করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট যারা করেন, তারা হচ্ছেন নেতা। পুলিশে, প্রাথমিক শিক্ষকে চাকরি দিয়ে যারা পাঁচ লাখ টাকা নেন, তারা হচ্ছেন নেতা। গরিব পিয়নের চাকরি দিয়ে তিন লাখ টাকা যারা নেন, তারা হচ্ছেন নেতা। চরের জায়গা দখল করে তারা হচ্ছেন নেতা। আবার তাদের মনোনয়ন দেয়া হয়।’
হঠাৎ কেন তিনি এ রকম বক্তব্য দিলেন? জানতে চাইলে কাদের মির্জা জানান, সম্প্রতি তিনি অসুস্থতার কারণে আমেরিকায় গিয়ে চিকিৎসকের কাছে জানতে পারেন তার পেটের ভেতর দুটি টিউমার আছে। যেকোনো সময় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে পারে। তখন তিনি সে দেশে শুয়ে শুয়ে নিজ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ভাবলেন। সর্বত্র অরাজকতা ও আর নানা অনিয়ম-দুর্নীতি তাকে মানসিকভাবে পীড়া দিল। আর আমেরিকা থেকে দেশে আসার পর তিনি বিমানবন্দরে বসে চিন্তা করলেন যত দিন বেঁচে থাকবেন, সব সময় সত্য কথা বলে যাবেন।
আবদুল কাদের মির্জা আরো বলেন, তার দেয়া বক্তব্যগুলো সঠিকভাবে কেউ উপস্থাপন করেনি। ফলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
আবদুল কাদের মির্জা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন ভোটের অধিকার ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। আমরা স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি ভাতের ও ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য। আজ শেখ হাসিনা সরকার ভাতের অধিকার দিয়েছে কিন্তু ভোটের অধিকার আমরা এখনো পায়নি বরং এ দেশে হ্যাঁ ও না করে ভোটের অধিকার হরণ করেছেন জিয়াউর রহমান। ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা এ দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করেছেন।’
কাদের মির্জা আবারও বলেন, ‘কিছু চামচা বলে ওমুক নেতার নেতৃত্বে নোয়াখালীতে বিএনপির দুর্গ ভাঙা হয়েছে। কিন্তু কতটুকু ভাঙা হয়েছে আমি সে বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছি, এখনো তিন থেকে চারটি আসন ছাড়া বাকিগুলোতে যারা দাঁড়াবে, ফেয়ার (নিরপেক্ষ) ভোট হলে তারা পালানোর জন্য দরজা খুঁজে পাবে না। তাহলে কিসের বিএনপির দুর্গ ভাঙা হয়েছে। বিএনপির দুর্গ ভাঙলে শেখ হাসিনা ভেঙেছে। কারণ সবখানে সবাই বলে শেখ হাসিনা একলা কী করবে। দুর্গ যা ভেঙেছে শেখ হাসিনা ভেঙেছে।’
আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘নোয়াখালী-৫ (কোম্পানীগঞ্জ-কবিরহাট) আসনে ওবায়দুল কাদেরের জনপ্রিয়তা বেশি; কারণ তিনি যে উন্নয়ন করেছেন মন্ত্রী না হলে তা করতে পারতেন না। এত এত উন্নয়ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মক্তব, রাস্তাঘাট, মসজিদ-মন্দির। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ওবায়দুল কাদেরের উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। তার নীতি-নৈতিকতার কারণে এ আসনে তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে।’
আবদুল কাদের মির্জা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘যারা প্রকাশ্য দিবালোকে একজন উপজেলা চেয়ারম্যানকে (ফেনীর ফুলগাজীর একরামুলক হক) প্রথমে গুলি করে পরে গাড়ির ভেতরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলল। তারা নাকি নেতা? এগুলো বলাই আমার অপরাধ।’
এসব ঘটনার পেছনের জড়িতরা আমাকে ধমকাচ্ছে। গুলি করার হুমকি দিচ্ছে। জনগণকে সাক্ষী রেখে কাদের মির্জা বলেন, ‘আগামী ১৬ জানুয়ারি বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচন। নির্বাচন বানচাল করার জন্য আমার এলাকায় অস্ত্র আনা হচ্ছে।’
আবদুল কাদের মির্জা বলন, ‘বিগত সংসদ নির্বাচনেও এই এলাকায় অস্ত্র কে কে এনেছে। কোথায় থেকে আনা হয়েছে, আমাদের দলের কারা কারা এনেছে সবার নাম-পরিচয় থানা-পুলিশকে দেয়া হয়েছে।’
এ সময় কাদের মির্জা কোম্পানীগঞ্জের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘সে মাদক, নারী, টেন্ডার থেকে শুরু করে সব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। সে এগুলো করেছে আবার তার লোক দিয়েও করাচ্ছে। এসব অপকর্ম করে সে এখন হাজার হাজার কোটি কোটি টাকার মালিক।’
এ সময় আবদুল কাদের মির্জা তার আপন ভাগিনার সমালোচনা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। তিনি দাবি করেন, ‘অস্ত্র ব্যবসায়ী, সড়কের চাঁদাবাজি, চোরাকারবারি স্বপন মিয়াজিকে দাগনভূঞা পৌরসভায় মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া উড়ির চরে হাজার হাজার একর জয়গা দখলকারী সেলিম স্থানীয় এমপি মিতার চামচাকেও মনোনয়ন দেয়া হয়েছ।’ তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সত্য কথা বলে যাব।’
এক প্রশ্নের জবাবে কাদের মির্জা বলেন, ‘আমি এসব কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কানে দিতে চাই। কিন্তু করোনার কারণে তার কাছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর গণভবনে গেলে অসহায় মানুষের কান্না আর কান্না। সারা দেশ থেকে অসহায় মানুষ প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাদের কষ্ট আর কান্নায় সেখানে সৃষ্ট হয় এক আবেগঘন পরিবেশ।’
আবদুল কাদের মির্জা বলেন, ‘এখনো তিন বছর সময় আছে সরকারের। আমরা যদি আমাদের দলকে সংশোধন না করি এবং আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হয়, তাহলে আমাদের দলের সংশোধন দরকার, দলের নেতাদের সংশোধন করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমাদের নেতারা তা কার্যকর করেনি। আমাদের প্রশাসন কার্যকর করেনি।’
কাদের মির্জা প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে অনুরোধ করে বলেন, ‘আপনি ঘোষণা দেন যারা মাদক ও নারীর সঙ্গে অনৈতিক কাজে জড়িত, তারা দলের কোনো পর্যায়ে জনপ্রিতিনিধি হতে পারবে না। প্রয়োজনে তাদের ডোপ টেস্ট করা হলে অনেক অনিয়ম কমে যাবে।’
আগামী ১৬ জানুয়ারি বসুরহাট পৌর নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা তার এখন প্রধান কাজ। তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে আমি একটি ভোট পাব। তারপরও এ নির্বাচন হবে অবাধ ও সুষ্ঠু। আমি ১৬ জানুয়ারি সব দলের নেতা-কর্মীদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেব গণতন্ত্র কাকে বলে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? এটি আমি এখান থেকে বুঝিয়ে দেব।’
স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করে কাদের মির্জা বলেন, ‘দেশে দুর্নীতির দায়ে অনেক রাজনৈতিক নেতাদের শাস্তি হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ খুশি কিন্তু এসব দুর্নীতির সঙ্গে তো প্রশাসনের লোকজনও জড়িত। তাদের তো শাস্তি হয় না। তারা ভাবে শেখ হাসিনাকে আমরা জিতাইছি। যা ইচ্ছা তা করব। তারা যদি নিজেরা ভোটের সময় আকাম করায়, তাহলেও তো ভোটে যা হবার তা-ই হবে।’
নিজ দল ও রাজনীতি এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে তার সাম্প্রতিক বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য আগামী ১৬ জানুয়ারি মেয়র পদে পৌর নির্বাচনে প্রভাব পড়বে কি না- জানাতে চাইলে আবদুল কাদের মির্জা বলেন, ‘আমি কোনো প্রভাবকে ভয় করি না। সুষ্ঠু ও নিরপক্ষে ভোটে আমার জয়-পরাজয় যা-ই হোক, আমি মাথা পেতে হাসি মুখে মেনে নেব। আমার প্রতিপক্ষ যে নির্বাচিত হবে তাকে মিষ্টিমুখ করে তার পর বাড়ি যাব।’
Leave a Reply