রবিবার, ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১১:৪৬ অপরাহ্ন
শনিবার সকালে নানীর সাথে বিজয় আর পারভেজ এসেছিলো সাভারে দুর্ঘটনাস্থলে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। যেখানে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজায় ভয়াবহ ধসে প্রাণ হারান বিজয়ের বাবা-মা ও খালা। নানী রাজিয়া বেগমের সংগে খালাতো ভাই পারভেজকে নিয়ে ধামরাইয়ের ফুটনগর থেকে তারা এসেছিলো স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানাতে। তাদের চোখে ছিলো শোক আর বুকে ছিলো চাপা কান্না।
সেদিনের ভবন ধসে রাজিয়া বেগমের দুই মেয়ে ও এক মেয়ের জামাই মারা যান। দুই মেয়েকে হারিয়ে তিনি এখন শোকে পাথর। বাংলাভিশন ডিজিটালের কাছে তিনি বলেন, নাতিরা তাঁর কাছেই থাকে। দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার আগে পিতা-মাতা হারানো বিজয় আর মা হারানো পারভেজকে যদি লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে পারেন, তাহলেই নানী হিসেবে তিনি সফল হবেন।
রাজিয়া বেগম আরো জানান, যৎসামান্য সাহায্য পেয়েছেন তা দিয়ে কষ্টের সংসার চলে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া নাতিদের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন।
পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া বিজয় বলে, শিশুকালে বাবা মা হারিয়েছি। সাহায্য কি চাইবো? বাবা-মাকে ফেরত চাই, অন্যথায় রানা প্লাজার মালিক রানার ফাঁসি চাই।
সেদিনের ভবন ধসের ঘটনায় রাজিয়া বেগমের মেয়েদের মতো আরও ১ হাজার ১৩৫ জন শ্রমিক মারা যান। ওই ঘটনায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। কিন্তু সেই মামলার বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় মামলা হয়েছে তিনটি। এর মধ্যে একটি হত্যা মামলা। একটি হয়েছে ইমরাত নির্মাণ আইনে। ভবনের নকশা-সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে সোহেল রানার বিরুদ্ধে অপর মামলাটি করা হয়। তবে একটি মামলারও বিচার শেষ হয়নি।
আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হত্যা মামলায় ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। আসামিদের মধ্যে কেবল সোহেল রানা কারাগারে। ৩২ জন জামিনে আছেন, পলাতক ৬ জন। ২ জন আসামি মারা গেছেন।
সরকারি কৌঁসুলিরা জানান, অভিযোগ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আট আসামি উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে আদালত অন্তর্র্বতীকালীন স্থগিতাদেশ দেন। পরে ছয়জন আসামির পক্ষে দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। তবে দু’জন আসামির পক্ষে স্থগিতাদেশ বহাল থাকায় মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং ওই সময়ের কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানের পক্ষে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ এখনো বহাল আছে। তাই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি।
মামলার দীর্ঘসূত্রিতা প্রসঙ্গে তিনি জানান, হত্যা মামলার ৪১ জন আসামির মধ্যে ৩ জন মারা গেছেন। বাকি ৩৮ জনের মধ্যে ৬ জন পলাতক। একমাত্র রানা প্লাজার মালিক কারাগারে আছেন। বাকিরা জামিনে আছেন। মামলার ৫৯৪ জন সাক্ষী।
মিজানুর রহমান আরো জানান, তারা চান মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। সেজন্য তিনি সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছিলেন। যাতে করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করে বিচারকাজ শেষ করা যায়।
ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে মামলাটি করেছিলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এই মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ওই বছরের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত অভিযোগ গঠন করেন। তবে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ এখনো শুরু হয়নি।
রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি আনোয়ারুল কবীর বাবুল বলেন, এ মামলায়ও সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র রেফায়েত উল্লাহর পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়নি।
অন্যদিকে, ভবনের নকশা–সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম চলছে ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে।
রানা প্লাজা ধসের দিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন যারা তাদের মধ্যে বুকে ও পায়ে গুরুতর আঘাত পাওয়া অনেকেরই এখনো চিকিৎসা চলছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে তাদের সংসার। কিন্তু যাদের কারণে এতো শ্রমিক মারা গেলেন, এতোগুলো মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করলেন, এখনো তাঁদের বিচার শেষ না হওয়ার বিষয়টি কিছুতেই মানতে পারেন না স্বজনহারানো মানুষেরা। তাদের আক্ষেপ, ‘আট বছর হয়ে গেল, আমরা বিচার পেলাম না। সামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে প্রিয়জন হারানোর বেদনা ভুলে যাওয়া কঠিন।’
রানা প্লাজা ট্রাজেডির বিচারে সময়ক্ষেপণ প্রসঙ্গে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, বিচার বিলম্বিত হওয়া দুঃখজনক।
রানা প্লাজার মালিক রানাকে মাদক ও অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে দাবি করে আমিরুল হক আমিন বলেন তাকে হত্যা মামলায় আসামি করা হয়নি। তাছাড়া ওই ভবনে যে পাঁচটি গার্মেন্টস ছিলো তার মালিকদেরও গ্রেফতার করা হয়নি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মস্থল ও কারখানা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আহত পঙ্গু শ্রমিকদের যথাযথ পুনর্বাসনের দাবি জানান তিনি।
Leave a Reply